বিশ্ব এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআইনির্ভর এক যুগান্তকারী প্রযুক্তিগত বিপ্লবের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। একসময় এটি ছিল কেবল গবেষণাগার ও একাডেমিক আলোচনার বিষয়, কিন্তু আজ এটি সরাসরি কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করেছে। ই-মেইলের উত্তর দেওয়া, প্রেজেন্টেশন তৈরি করা, বিপুল পরিমাণ তথ্য বিশ্লেষণ করা কিংবা গ্রাহকসেবা পরিচালনা করার মতো কাজ এখন ক্রমেই এআই দিয়ে সম্পন্ন হচ্ছে। ফলে অফিস, কারখানা ও সেবা খাতের কাঠামো দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে।
এ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নেতৃত্বের ধারণাও আমূল বদলে গেছে। আগে লাইন ম্যানেজারের প্রধান কাজ ছিল নিয়মিত কার্যক্রম তদারক করা, সময়মতো কাজ শেষ করানো ও রিপোর্ট তৈরি করা। এখন তাঁর দায়িত্ব আরও বিস্তৃত। তিনি আর শুধু তদারককারী নন; বরং প্রযুক্তি ও মানুষের মধ্যে সেতুবন্ধকারী, দলের অনুপ্রেরণাদাতা এবং প্রতিষ্ঠানের ভেতরে পরিবর্তনের অন্যতম চালিকা শক্তি।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) হিসাব অনুযায়ী, আসন্ন ‘রোবট বিপ্লব’ ২০২৫ সালের মধ্যে বিশ্বে প্রায় ৮ কোটি ৫০ লাখ চাকরি বিলুপ্ত করতে পারে। তবে আশার খবর হচ্ছে, একই সময়ে প্রায় ৯ কোটি ৭০ লাখ নতুন চাকরি তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে নেট হিসাবে ১ কোটি ২০ লাখ নতুন কর্মসংস্থান যোগ হবে। ডব্লিউইএফের আরেকটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৫ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে প্রায় ১৭ কোটি নতুন চাকরি সৃষ্টি হতে পারে, যদিও একই সময়ে ৯ কোটি ২০ লাখ চাকরি হারিয়ে যাবে। এতে নেট হিসাবে নতুন চাকরি যুক্ত হবে প্রায় ৭ কোটি ৮০ লাখ। বিশেষ করে ভারত ইতিমধ্যেই এআই খাতে এগিয়ে যাচ্ছে। দেশটিতে ২০২৭ সালের মধ্যে অন্তত ২৩ লাখ নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশে এআইয়ের প্রভাব বিশেষভাবে চোখে পড়বে তৈরি পোশাক, কৃষি, ব্যাংকিং, তথ্যপ্রযুক্তি ও গ্রাহকসেবা খাতে। তৈরি পোশাক খাতে ব্যাপক হারে অটোমেশন এলে বিপুলসংখ্যক শ্রমিকের চাকরি হারানোর ঝুঁকি রয়েছে। তবে একই সময়ে কৃষিক্ষেত্রে এআইভিত্তিক প্রযুক্তি, যেমন ফসল পর্যবেক্ষণ বা কৃষি পরামর্শক অ্যাপ ব্যবহার করলে উৎপাদনশীলতা বাড়বে, কৃষক সরাসরি উপকৃত হবেন। দেশের বাস্তবতায় এটি এক বড় দ্বন্দ্ব তৈরি করবে। কারণ, বর্তমানে প্রায় ২৭ লাখ ৩০ হাজার মানুষ বেকার। এর ওপর যদি দক্ষতার ঘাটতি, খাতভিত্তিক বৈষম্য ও অকার্যকারিতা যুক্ত হয়, তবে চ্যালেঞ্জ আরও বাড়বে। তাই বোঝা যায়, এআইয়ের এক দ্বৈত চরিত্র আছে। এটি একদিকে পুরোনো চাকরি ও ভূমিকা ভেঙে দেয়, অন্যদিকে নতুন সুযোগ তৈরি করে তাঁদের জন্য, যাঁরা শেখার আগ্রহী ও অভিযোজনক্ষম।
এরই মধ্যে এআই বহু নিয়মিত কাজ স্বয়ংক্রিয় করে ফেলেছে। আগে যেসব কাজে লাইন ম্যানেজারের অনেক সময় ব্যয় হতো, এখন সেগুলো দ্রুত ও কার্যকরভাবে সম্পন্ন হচ্ছে। ফলে লাইন ম্যানেজারের ভূমিকা চারটি নতুন মাত্রায় রূপ নিয়েছে। তাঁরা এখন ঠিক করেন, কোন কাজ এআই করবে আর কোন কাজ মানুষের হাতে থাকবে। কর্মীদের পাশে থেকে তাঁদের সৃজনশীলতা, মনোবল ও আত্মবিশ্বাস বাড়ানো তাঁদের দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে। একই সঙ্গে তথ্য ব্যবহারে ন্যায়বিচার, গোপনীয়তা ও নৈতিকতা রক্ষা করতে হয়। পাশাপাশি নতুন প্রযুক্তি গ্রহণে নেতৃত্ব দেওয়া এবং প্রতিষ্ঠানকে উদ্ভাবনী সংস্কৃতির দিকে নিয়ে যাওয়াও তাঁদের ওপর নির্ভর করছে।
