ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে। ৯ সেপ্টেম্বর হবে এই নির্বাচন। প্রায় ছয় বছর পর হতে যাচ্ছে এই নির্বাচন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এই একটি বিষয় লক্ষণীয়। ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়টি। ১৯২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে ডাকসু প্রতিষ্ঠিত হয়। তখনো ডাকসু নামকরণ হয়নি। পরে ১৯৫৩ সালে গঠনতন্ত্র সংশোধনের মাধ্যমে পূর্ব নাম পরিবর্তন করে বর্তমান নাম গ্রহণ করা হয়।
বলা যায়, ডাকসুর ইতিহাস সাত দশকের বেশি সময়। নিয়ম অনুযায়ী, এ সময় অন্তত ৭০ বার ডাকসু নির্বাচন হওয়ার কথা। কিন্তু তা হয়নি। যেমন এবারের নির্বাচনটি হতে যাচ্ছে প্রায় ছয় বছর পর। ছয় বছর আগে যে নির্বাচনটি হয়েছিল, সেটি আবার হয়েছিল প্রায় তিন দশক পর।
বলা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচন বিষয়টি কখনো নিয়ম মেনে হয়নি। যদিও ছাত্রদের প্রতিনিধি পরিষদ হিসেবে এবং তাঁদের আশা-আকাঙ্ক্ষা
ও আন্দোলনের প্রতীক হিসেবে ডাকসু সমগ্র দেশের ছাত্রদের আবেগ, অনুভূতি ও অভিব্যক্তির এক মূর্ত প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এবার এমন এক সময় ডাকসু নির্বাচন হতে যাচ্ছে, যখন মাত্রই শিক্ষার্থীরা আরেকটি রক্তের নদী সাঁতরে তীরে এসে দাঁড়িয়েছেন। মাত্র ৩৬ দিনে ফ্যাসিস্ট সরকার হত্যা করেছিল ১ হাজার ৪০০ মানুষকে। তারও আগে চলতে থাকা ১৫ বছরের আন্দোলনে কত মানুষ যে মারা গেছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান করা হয়নি।
কী রকম হবে এবারের ডাকসু নির্বাচন? কেমন হবে তার চালচিত্র ও চরিত্র? মনে রাখা দরকার, এক বছর পরও এই মহান অভ্যুত্থানের স্মৃতি মানুষের মনে দগদগে ও জীবন্ত। এই অভ্যুত্থানেই বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ আগুন-ঝরানো অবিস্মরণীয় সাহসী আত্মদানের উদাহরণ তৈরি করেছেন, পৃথিবীতে যার তুলনা মেলা ভার। দেশপ্রেমিক বীরদের এই মহান আত্মদান দেশের মানুষের মধ্যে এক অসাধারণ আকাঙ্ক্ষা তৈরি করেছে। এক নতুন দেশ গড়ব আমরা, ফ্যাসিবাদকে আর কখনো এই দেশে প্রতিষ্ঠিত হতে দেব না, লুটেরা খুনিদের বিচার করব এ দেশের মাটিতেই। একটি কল্যাণময় শান্তির দেশ গড়ে তুলব, এই রকম আকাঙ্ক্ষা।
ডাকসু নির্বাচনের পটভূমিতেই এ বক্তব্যগুলো কি প্রাসঙ্গিক? অবশ্যই। যখন আন্দোলন চলে, তখনই মানুষ প্রশ্ন করেছিল, অনেক তো হলো। সেই বায়ান্ন থেকে আজ পর্যন্ত মানুষ রক্ত তো কম দিল না, এই অবস্থার কি বদল হবে? তখন এসেছিল সংস্কারের কথা। সংস্কার প্রসঙ্গে এখানে বিস্তারিত বলার অবকাশ নেই। ইতিমধ্যে দুই মাস ধরে সংস্কার কমিশন তথা জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এ পর্যন্ত এর ওপর কাজ করছে। কেবল আবেগ দিয়ে, বিক্ষোভ দিয়ে তো দেশ গড়া যাবে না। তার জন্য প্রয়োজন ঠান্ডা মাথায় সুচিন্তিতভাবে দেশ গড়ার কর্মসূচি বা সনদ তৈরি করা, যে কাজ এখনো চলমান আছে।
এখানেও ছাত্রদের ভূমিকাকে বিশেষ প্রণিধানযোগ্য মনে করি। আমাদের মতো পশ্চাৎপদ, কম শিক্ষার হারের দেশে শিক্ষার্থীরাই হচ্ছেন জ্ঞানের তথা সংস্কার আন্দোলনের ভ্যানগার্ড। এটি একমাত্র সংরক্ষিত শক্তি, যা একাধারে লড়াই করে আবার জ্ঞানের আলোকে সংগঠিত করে।
আমাদের দেশে এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের এই ভূমিকা আমরা বেশ কয়েকবারই প্রত্যক্ষ করেছি। সবাই জানে ভাষা আন্দোলনের সময় সাহসের সঙ্গে সরকারের প্রতিরোধ মোকাবিলা করে ১৪৪ ধারা ভাঙতে রাজনৈতিক নেতৃত্ব বরং বিরোধিতাই করেছিল। কিন্তু ছাত্ররা সেই বাধা মানেননি। সে জন্যই ভাষা জিতেছিল। ১৯৬০-৬২ সালেও হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশনকে প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলন করেছিলেন শিক্ষার্থীরা, যা আবারও জয়লাভ করেছিল। ছেষট্টিতে শেখ মুজিবুর রহমান যে ছয় দফা দিয়েছিলেন, তাকে জাতির সামনে যুক্তি দিয়ে বৈষম্যের বিরুদ্ধে ‘ম্যাগনা কার্টা’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন এই ছাত্ররাই। সেদিন ট্রেড ইউনিয়ন দৃষ্টিভঙ্গিতে যদি আন্দোলন পরিচালিত হতো, তাহলে বাংলাদেশের ইতিহাস অন্য রকম হতো।
আমি নিশ্চিত, এবারের ডাকসুও চব্বিশের চেতনার ধারক। এখন পর্যন্ত সারা দেশে সেই চেতনার ফল্গুধারা প্রবাহিত। কিন্তু এ-ও সত্যি, অতীতের ট্রমা থেকে আমরা এখনো মুক্ত নই। আরও একটা কথা বলা দরকার, এ রকম উদাহরণ অনেক আছে, যখন বৈপ্লবিক সংস্কারের চিন্তাধারা নির্বাচনের মিথ্যা অঙ্গীকারের তোড়ে উড়ে গেছে। এই আশঙ্কা অনেকেই করছে। এ জন্যই প্রস্তাব আসছে সংস্কার বিষয়ে যে ৮২টি প্রস্তাবে আমরা একমত হয়েছি, তা যাতে নির্বাচনের চোরাবালিতে হারিয়ে না যায়, সে জন্য সুস্পষ্ট অঙ্গীকার থাকতে হবে। কেউ কেউ একে আইনি সুরক্ষা দিতে বলছে।
এবার যে ডাকসু গঠিত হবে, দেশবাসীর কাছে তাদের কী অঙ্গীকার থাকবে? আমরা কী ধরনের ডাকসু চাইব? দেশের ২০ কোটি মানুষের যাঁরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন না, তাঁদের কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের কাছে তথা ডাকসুর কাছে কোনো প্রত্যাশা থাকতে পারে? যখন কোটা সংস্কার আন্দোলন ছিল, তখন কি মানুষ প্রশ্ন তোলেনি? ছাত্ররা কি কেবল তাঁদের দাবিদাওয়ার কথা বলবেন, নাকি দেশের কথাও বলবেন? মানুষ মহা আনন্দে দেখেছিল ছাত্ররা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে জনগণের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। এটাই ৭৩ বছরের (১৯৫২ থেকে ২০২৫) ছাত্র-জনতার সংজ্ঞায়িত সম্পর্ক। এই সম্পর্কের বন্ধন অটুট অভিন্ন। এখান থেকে কেউ সরে যেতে পারবে না।
এটা ঠিক, ১৫ বছরে ফ্যাসিবাদ ছাত্র-জনতার মনে যে ট্রমা তৈরি করেছিল, তার নেতিবাচক প্রকাশ হিসেবে অনেকে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করে দেওয়ার কথা বলছিলেন। এখনো বলেন। এখনো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মনে করে, হলে হলে ছাত্ররাজনীতি ছাত্রদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে। তারা হলে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করার কথা বলে। তারা ভুলে যায়, তৎকালীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের নির্দেশে ছাত্রদের ওপর যে হামলা হয়েছিল, তা হলের বাইরে থেকে এসেছিল। ভেতর থেকে এ সমস্যা তৈরি হয়নি।
যদিও মনে হচ্ছে, এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি, তবু সহজ একটা কথা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ভুলে না যেতে অনুরোধ করব যে এবার ডাকসু নির্বাচন হবে চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের বিশাল দেশবদলের চেতনার আলোতে। এমনিতেই নির্বাচনটি একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া, তার ওপর চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান পরিপূর্ণভাবেই রাজনৈতিক ও জ্বলন্ত। হলগুলোতে প্যানেল পরিচিতি সভা হবে তো? সেখানে হলের বাইরের ছাত্র বা নেতারা বক্তৃতা করবেন তো? তাঁরা কি রাজনীতি বাদ দিয়ে বক্তৃতা করতে পারবেন? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ ডাকসুর সাবেক ভিপি হিসেবে আমি যেতে পারব? আমাকে কি রাজনীতিবিবর্জিত বক্তৃতা করতে হবে? হাসব? না কাঁদব?
কিছু কিছু কথা শুনছি। কেমন হবে ডাকসু নির্বাচন? কাদের কাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হবে প্রধানত? এবং অবাক বিস্ময়ে আরেকটি কথা শুনছি। অনেকেই নাকি স্বতন্ত্র দাঁড়ানোর কথা ভাবছেন? নাম বলব না। দু-একটি পরিচিত সংগঠনের নেতা-নেত্রীরা নিজেদের রাজনৈতিক পরিচয় মুছে ফেলার চেষ্টা করছেন (তাঁরা এই এক বছরে অল্পবিস্তর পরিচিতি লাভ করেছেন বটে)। তাঁরা নাকি স্বতন্ত্র নির্বাচন করবেন? কারও কারও কথায় এ রকমও শুনেছি যে তাঁরা সম্প্রতি হলে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের যে তৎপরতা চলেছিল, তাতে সায়ও দিয়েছিলেন।
ডাকসু হলো ছাত্রদের, শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়; সারা দেশের ছাত্রদের আন্দোলনের বাতিঘর। নেহাত নিজেদের কমিউনিটি স্বার্থ রক্ষার হাতিয়ার নয়।
